রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
মানুষসহ প্রাণিকুলে সবাই নাকি পরিষ্কার পানি পান করে। গাধাই কেবল জল ঘোলা করে খায়। ক্রমবর্ধমান এবং পরিবর্তনশীল পৃথিবীর এই তত্ত্বও পাল্টাতে শুরু করেছে। এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ আর সেই মানুষদের মধ্যে যারা হর্তাকর্তা তারাই জল ঘোলা করা নিয়ে ব্যস্ত। বিশ্বব্যাপী মোড়লরাও দুনিয়াকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে ঘোলা জলের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। কোনো কিছু আর পরিষ্কার করে দেখা হচ্ছে না। সবকিছুতেই একটা গোলমেলে প্যাঁচানো ভাব। অবশ্য এই যে ‘গাধা জল ঘোলা করে পান করে’ এই তথ্যের উদ্ভাবকও তো মানুষের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারাই। নিশ্চয়ই এত দিনে একটা পক্ষ ‘ঘোলা জলের সুবিধা’ও আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
যাই হোক গ্লোবাল ভিলেজে যেমন দুনিয়াদারির খবর রাখতে হয়, তেমনি নিজের ঘরের খবরটা তো সবার আগে রাখতেই হয়। দুনিয়া চলতে যেমন রাজনীতি আর কূটনীতির একটা জটিল সমীকরণ দরকার, তেমনি এর অর্থনীতিকে তো আর আলাদা করা যায় না। অর্থনীতির কেন্দ্রে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তার চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। বড় দেশের কথা বাদ দিলে ছোট দেশগুলোও দুইশ বছর ধরেই নিজেদের বাজার অর্থনীতির দিকেই বেশি জোর দেয়। আমার ছোটবেলায় ভোক্তা অধিকার শব্দটিই আমি শুনিনি। সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে একা বা একত্র হয়ে বাঁচার লড়াই করে আসছিল। এখন সবাই ভোক্তা শব্দের সঙ্গে পরিচিত। ভোক্তা অধিকারও জানে কিশোররা। ওরা পরিষ্কারভাবেই জানে।
ঈদের পর গত শনিবার মগবাজারের কাছের এক সুপারশপে ১২-১৩ বছরের কিশোরীকে তার বাবার সঙ্গে দেখলাম। সব জিনিস নিচ্ছে আর দাম দেখছে এবং মেয়াদ আছে কী নেই তা পরীক্ষা করছে। বাবা দুই লিটার তেল কিনল। সেই তেলের দাম দেখল। সেখানে দামের যে ট্যাগ তার ওপর নতুন ট্যাগ আবিষ্কার করল। সরকার নির্ধারিত নতুন দাম প্রতি লিটার ১৯৮ টাকা করে দুই লিটার ৩৯৬ টাকা লেখা। সে নতুন ট্যাগটা খুলে ফেলল। আগের ট্যাগ বের করল। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলছে।বুঝতে বাকি নেই তেলগুলো আগের কেনা। সরকার দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন দাম জুড়ে দিয়েছে। এটা একটা ছোট্ট ঘটনা।
যদিও আমরা দেখেছি ঈদের আগেই বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট বাধিয়ে বাড়তি দাম নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের লক্ষ্যই ছিল তেলের দাম বাড়ানো। ক্রেতারা হিমশিম খেয়েছেন। তেলের সঙ্গে তাদের চিনি কিংবা চা-পাতা কিনতে হয়েছে। আর অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনয়ী বাণিজ্যমন্ত্রী বরাবরের মতোই বলেছেন, ‘আমরা দেখছি। বাজার আমাদের নিয়ন্ত্রণে। সরবরাহে ঘাটতি আছে। ঈদের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বাজার বিশ্লেষক এবং খুচরা বিক্রেতারাও বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছে সয়াবিন। তারা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা বলে আগের মজুদ করা তেলের দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাঁকাতে বুদ্ধি এঁটেছেন। আর কর্র্তৃপক্ষ মানে মন্ত্রী মশায় বলছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঈদ ঢেকেছেন মিষ্টি মিষ্টি আশ্বাস দিয়ে। আর ঈদের পর গত বৃহস্পতিবার প্রথম দিনই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে তেলের দামে রেকর্ড গড়ে দিয়েছেন। আর তেলের সংকটের তীব্রতা বোঝাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর পরও বাজারে তেল সরবরাহ করেননি। গত চার দিনেও এর সমাধান হয়নি। আসলে যা হলো তা হচ্ছে, পুরনো মজুদের দাম বাড়িয়ে বিক্রি। এর আগে পেঁয়াজ এবং চাল নিয়েও একই কাহিনী।
দাম বাড়ানোর চার দিনের মাথায় মন্ত্রী মহোদয় বলে উঠলেন, ‘ভোজ্য তেল নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের কথা রাখেননি।’ মন্ত্রী ব্যর্থতার দায় স্বীকার করলেন। বললেন, ‘আমাদের ব্যর্থতা। কারণ ব্যবসায়ীদের বলেছিলাম রমজানকে সামনে রেখে দাম বাড়াবেন না। কিন্তু তারা ঈদের সাত দিন সেই কথা রাখেনি। আমাদের সব অর্গানাইজেশনকে বলেছি, যে দাম নির্ধারিত আছে সেটি যাতে ঠিক রাখা হয়।’ ঈদের আগে যখন সংবাদমাধ্যম তেলের কৃত্রিম সংকট এবং তেলের জন্য মানুষের হাহাকারের কথা বলা হয়েছে তখন এই সিন্ডিকেট ধরা সহজই ছিল। মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের কথাকেই প্রাধান্য দিলেন। না বুঝলেন ভোক্তার কথা, না শুনলেন সংবাদমাধ্যমের কথা।
এখন দাম বাড়িয়ে মজুদের ব্যবসার সব সুযোগ করে দিয়ে মহাশয় বললেন, ‘আমরা সিন্ডিকেট খুঁজে বের করছি। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে অনেকে তেল ধরে রাখল। কারচুপিটা এখানেই হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে যেন এগুলো না হয় সেটি দেখতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, তাদের অনুরোধ করা ঠিক হয়নি যে রমজানে তেলের দাম না বাড়ানোর। কারণ তাদের যদি একটি দাম বৃদ্ধি করে দিতাম তাহলে এটি হতো না। ভারতে তেলের দাম কত? তাদের দামও ১০-১২ টাকা বেশি আছে।’
মন্ত্রী এখন বললেন, ‘আমরা মনিটর করব। তবে ব্যবসায়ীদের চাপ দিতে চাই না। মানুষের ক্রাইসিস হলে ইন্টারফেয়ার করতে হবে। ব্যবসায়ীরা মাঝে অনেকে সুযোগ নিয়েছেন, কারণ তারা জানেন ঈদের পর দাম বাড়বে। সেজন্য তারা মজুদ করে রেখেছিলেন। রিটেইলার অপরাধ করলে সংগঠনেরও ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সবিশেষ বলতে চাই, আমাদের অত্যন্ত ভদ্র-বিনয়ী বাণিজ্যমন্ত্রী তিন বছর ধরে কি ঘুমিয়ে আছেন? তিনি কি দেখছেন না, আমদানিনির্ভর পণ্যের সিন্ডিকেট কতটা শক্তিশালী এবং তারা কীভাবে জনগণের কাছ থেকে দুই সপ্তাহ থেকে এক-দেড় মাসের মধ্যে কয়েক বছরের মুনাফা করে নিচ্ছেন। নাকি তিনি জেগে ঘুমাচ্ছেন। নাকি গতবারের পেঁয়াজ ও চালের মতো সরকারপ্রধানের কঠোর হুঁশিয়ারির পর এবারও সিন্ডিকেট ধরতে ঘোলাপানিতে নেমেছেন। মন্ত্রী মহোদয় সরল এবং মিহি বাক্যে ব্যবসায়ীদের ওপর আলতো দোষ চাপিয়ে ভোক্তার মনে কোমল স্থান পাওয়ার যে সংবাদ সম্মেলন করলেন এটি কি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো নয়?
লেখক : সাংবাদিক
ভয়েস/আআ/সূত্র: দৈনিক দেশরূপান্তর।